তথ্যে কারচুপি দিয়েই চলছে ‘গরিব কল্যাণ’

 তথ্য গোপন, কারচুপি থেকে জনগণনায় টালবাহানা করেই ‘গরীব কল্যাণের’ মিথ্যের ফানুসে মোদী সরকার হাওয়া জুগিয়ে চলেছে। নানা জায়গায় মোদী সরকার দাবি করেছে, ৪ কোটি পরিবারকে নাকি পাকা বাড়ি দেওয়া হয়েছে, ৮১ কোটি মানুষকে প্রতি মাসে বিনামূল্যে রেশন দেওয়া হয়েছে, ৫৫ কোটি মানুষকে নাকি ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্পে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এই প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি প্রচারে ‘বরাদ্দ’ এবং ‘প্রাপ্তের’ ফারাক মুছে দেওয়ার জঘন্য চেষ্টা চলছে। এই বিজ্ঞাপনী কারসাজিতে জনগণকে বোকা বানানো হচ্ছে। সরকারি রিপোর্টে এসব ‘বরাদ্দ’ (অ্যালোকেটেড) করার কথা বলা হয়েছে ঠিকই, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা এখনও ‘প্রাপ্ত’ নয়। অর্থাৎ ৪ কোটি পরিবারের পাকা বাড়ি পাওয়ার কথা ঠিকই, কিন্তু সেই বাড়িগুলো এখনও তৈরি হয়নি। ৮১ কোটি মানুষের বিনামূল্যে রেশন পাওয়ার কথা, কিন্তু সেই সংক্রান্ত কাগজপত্র এখনও পাড়ার রেশনের দোকানে এসে পৌঁছায়নি। ৫৫ কোটি মানুষের বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়ার কথা, কিন্তু তাঁদের কাছে ‘আয়ুষ্মান ভারত কার্ড’-ই এসে পৌঁছয়নি। 
সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাঙ্কের এক রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, দেশে ‘অতি দারিদ্রের’ হার ২০১১-এ ১৬.২ শতাংশ থেকে কমে ২০২৩-এ ২.৩ শতাংশে এসে ঠেকেছে। ভারতের প্রায় ১৭ কোটি মানুষ নাকি এখন ‘অতি দারিদ্রের’ থেকে মুক্ত। নিম্ন মধ্যবিত্তদের মধ্যে দারিদ্রের প্রবণতা নাকি এই সময়কালে অন্তত অর্ধেকের কমে নেমে গিয়েছে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের এই রিপোর্ট ধরেই যথারীতি ‘বিকাশিত ভারতের’ ঝাঁ চকচকে ছবি প্রচারে নেমে পড়েছে গোদী মিডিয়া। বিভিন্ন মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যমও এই ‘গরীব কল্যাণের’ এই মরীচিকায় প্রভাবিত হয়। এদিকে অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, তথ্য কারচুপি এবং ইচ্ছা করে গবেষণার পদ্ধতি পালটেই সরকারের একেবারে মন মতো তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। মূলত ২০১১-১২র ‘কনসাম্পশান এক্সপেন্ডিচার সার্ভে’ ও ২০২২-২৩র ‘হাউজহোল্ড কনসাম্পশান এক্সপেন্ডিচার সার্ভে’-র ভিত্তিতে বিশ্ব ব্যাঙ্ক দারিদ্র হ্রাসের এই দাবি করেছে। এই দুই সমীক্ষাই গড়পড়তা যে কোনও পরিবার খাবারের পিছনে কত খরচ করে, তা যাচাই করতে করা হয়। 
এদিকে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন দু’টি সমীক্ষার রিপোর্ট কোনও ভাবেই একে অপরের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। সমীক্ষায় যাদের মতামতকে তথ্যের আকারে তুলে ধরা হয়েছে, তাদের দুই ক্ষেত্রে একেবারে ভিন্ন বা অসম্পর্কিত প্রশ্ন করা হয়েছে। সেই উপায়ে সমীক্ষাকে সরকারি প্রচারের অনুকূল করতে অন্যায় ভাবে প্রভাবিত করা হয়েছে। 
যে কোনও সমীক্ষা করতে গেলে গবেষকরা আপামর জনসংখ্যার মধ্যে থেকে এক দল লোককে নির্বাচিত করেন। রাশিবিজ্ঞানের ভাষায় একে ‘নমুনা’ (স্যাম্পেল) বলে। সমীক্ষার ফলাফল যাতে সঠিক ভাবে পাওয়া যায়, তার জন্য এই ‘নমুনার’ মধ্যে যত ভিন্ন শ্রেণি, জাত, লিঙ্গ, সম্প্রদায় ও অঞ্চলের মানুষ রাখা যায়, সমীক্ষকদের সেই চেষ্টাই থাকে। তবে ২০২২-২৩র সমীক্ষায় তথ্য যাতে সরকারি প্রচারের দাবির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে, তার প্রাণপণ চেষ্টা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের একাংশ। প্রথমত, ইচ্ছে করে এমন ‘নমুনা’ হিসেবে এমন ব্যক্তিদের রাখা হয়, যাদের থেকে মনমতো উত্তর পাওয়া যাবে। দ্বিতীয়ত, সমীক্ষার জন্য এমন স্থান নির্বাচন করা হয়েছে, যেখানকার অবস্থা ততটা খারাপ নয়। তৃতীয়ত, সমীক্ষায় ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ‘নমুনা’-দের এমন প্রশ্ন করা হয়েছে যার উত্তর সরকারি প্রচারের অনুকূল হয়। যোজনা কমিশন তুলে দিয়ে মোদী সরকার যে ‘নীতি আয়োগ’ তৈরি করে, সেই সংস্থাই এই গোটা তথ্য কারচুপি প্রকল্প তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিল। খোদ বিশ্ব ব্যাঙ্কের এই রিপোর্টই জানিয়েছে, নতুন সমীক্ষায় পদ্ধতিগত কৌশলে বদল আনা হয়েছে। 
উদাহরণ স্বরূপ, ধরা যাক ২০১১-র সমীক্ষায় কোনও এক ‘নমুনা’-কে তাঁর পরিবারের মাসিক খাওয়ার খরচ জানতে চাওয়া হয়। ধরা যাক সেই ব্যক্তি গ্রামের বাসিন্দা। সে হয়ত বলল ৫০০ টাকা। এই উত্তরের ভিত্তিতে তাঁকে ‘অতি দরিদ্র’ বলে চিহ্নিত করা হয়। এদিকে ২০২২-র সমীক্ষার ক্ষেত্রে প্রথমেই খাবারকে ‘পচনশীল’ (দুধ, শাক, সবজি) ও ‘পচনশীল নয়’ (চাল, আটা, ডাল) এমন দু’টি ভাগে বিভক্ত করা হয়। সেই আগের ব্যক্তিকেই যদি তাঁর পরিবারের মাসে সবজির পিছনে কত টাকা খরচ হয় তা জিজ্ঞাসা করা হয়, সে হয়ত বলছে এক হাজার টাকা। সরকারের রিপোর্টে যেহেতু এই শ্রেণির ব্যক্তিদের বিনামূল্যে রেশন ‘বরাদ্দ’ করার কথা বলা হয়েছে, তাই আগে থেকেই ধরে নেওয়া হয়েছে চাল, আটা বা ডালের পিছনে তাঁর কোনও খরচ হয় না। তবে বিনামূল্যে রেশন যেহেতু বরাদ্দ হলেও প্রাপ্য নয়, তাই তাতে অন্তত ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা তাতে খরচ করতে হচ্ছে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে এই ‘নমুনা’ হিসেবে নির্বাচিত ব্যক্তির পরিবারে খাওয়ার খরচ প্রায় দেড় হাজার টাকার কাছাকাছি। সরকারি সমীক্ষকরা প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ধরে নিচ্ছেন, ২০১১-এ ‘অতি দরিদ্র’ হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তি ২০২২-এ খাবারের পিছনে অন্তত দ্বিগুণ বেশি খরচ করতে পারছেন। ফলে তাঁর ক্রয় ক্ষমতায় ১০০ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে। ফলে তাঁকে আর ‘অতি দরিদ্র’ বলা যায় না। 
উলটোদিকে বিশেষজ্ঞদের মত, জনসংখ্যার বড় অংশকে আগের তুলনায় খাবারের পিছনে বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে মানে এই নয় যে তাদের আর দারিদ্র নেই। বরং খাদ্যে বেলাগাম মূল্যবৃদ্ধির জেরে গরিব মানুষ কী ব্যাপক সমস্যার মুখোমুখি, তা আরও বেশি করে প্রমাণ হচ্ছে। যদি খাবারের খরচ এবং মজুরি সমান তালে বাড়ত, তবে হয়ত দারিদ্র কমেছে বলে দাবি করা বিজ্ঞান সম্মত হত। তবে গত দশ বছরে মজুরিতে তেমন আশাপ্রদ কোনও পরিবর্তন দেখা যায়নি। ২০১১ থেকে ২০২৫-র মধ্যে খাবারের দাম গড় বৃদ্ধির হার ১৬৬ শতাংশ। কিন্তু মজুরিতে গড় বৃদ্ধি ৯২ শতাংশ। অর্থাৎ যে কোনও ব্যক্তি তাঁর আয়ের যতটুকু অংশ খাবারের পিছনে খরচ করে থাকেন, তা অনেকটা বেড়েছে। গড়ে হিসেব করলে, যে কোনও ব্যক্তি আগে তাঁর বেতনের ৩৩ শতাংশ খাবারে খরচ করতেন। এখন তিনি অন্তত ৫০ শতাংশ খরচ করতে বাধ্য হচ্ছেন। গরিব মানুষ, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের জন্য তা আরও বেশি। এই অংশের মানুষের আয় প্রায় বাড়েনি বললেই চলে, তবে খাবারের খরচ অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, অনেক সময় আয়ের প্রায় ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত তাঁদের খাবারের পিছনে খরচ করতে হচ্ছে।  
পাশাপাশি দারিদ্র মাপার আরেক মাধ্যম নিয়েও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। ২০২৪-এ ‘মাল্টি ডাইমেনশানাল পভার্টি ইন্ডেক্স’ (বহুমাত্রিক দারিদ্র সূচক)-র ভিত্তিতে দেশে দারিদ্র কমেছে বলে মোদী সরকারের নীতি আয়োগ এক রিপোর্ট প্রকাশ করে। তবে বেশ কয়েক জন অর্থনীতিবিদ এই রিপোর্টে তথ্য কারচুপির অভিযোগ করেছে। এই ক্ষেত্রেও একই কায়দায় খরচে বৃদ্ধির সূচক ধরেই পরিস্থিতিতে উন্নতির বিশ্লেষণ করা হয়েছে।